স্বর্ণ ব্রীজ ( প্রথম পর্ব ) The Golden Bridge

প্রথম পর্ব ঃ




সে অনেক কাল আগের কথা। বিজয়নগর নামে এক সুন্দর রাজ্য ছিলো আর সেই দেশের রাজার এক সুন্দরী রাজকন্যা ছিলো। সেই মেয়েকে নিয়ে রাজা পড়লেন এক ঝামেলায় কারণটা তার রাজকন্যার সৌন্দর্য নিয়ে। প্রতিদিন ই বিভিন্ন দূর দূরান্তের রাজ্য থেকে রাজকন্যার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসতো কিন্তু রাজা চাইতেন  যে তার মেয়েকে এই রাজ্যেই বিয়ে দিবেন যাতে সে তার মেয়েকে সবসময় দেখতে পারেন।

 

সাত সাগরের ওপারের রাজ্য রূপনগর, সেই রাজ্যের রাজকুমার রাজকন্যাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় কিন্তু মেয়েকে হারানোর ভয়ে রাজা সেই বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। রূপনগরের রাজা তো গেলেন ভীষণ খেপে। সে এই অপমানের বদলা নিতে রীতিমতো যুদ্ধ বাজিয়ে দিলেন। সেই যুদ্ধ চললো প্রায় ১ বছর। উভয় রাজ্যেরই অনেক ক্ষয়ক্ষতিও হলো।পরে উভয় রাজ্যে সন্ধি হয় কিন্তু এইভাবে আর কয়দিন। নিয়মিতভাবেই বিভিন্ন রাজ্য থেকে তার মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসতেই থাকে।


তাই রাজা এই সমস্যা থেকে বাচতে এক বুদ্ধি বের করলেন। একদিন রাজা ঘোষণা দিলেন যে তার প্রাসাদের সামনে নদীর উপর যে একটা  স্বর্ণের ব্রীজ বানিয়ে দিতে পারবে তার সাথেই সে তার মেয়েকে বিয়ে দিবেন।সারা রাজ্যে ঢেরা পিটিয়ে জানিয়ে দেওয়া হলো। বিভিন্ন রাজ্যেও এই খবর পৌছে গেলো। রাজার বুদ্ধিও কাজে লাগলো। এই ঘোষণা শুনে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আর কেউ আসতো না কারণ অত বড় নদীর উপর দিয়ে স্বর্ণের ব্রীজ করা কারো পক্ষেই সম্ভব না। 


🍁🍁🍁🍁🍁


বিজয়নগর রাজ্যের শেষ সীমানায় এক ছোট্ট কুড়েঘর। সেই কুড়েঘরে থাকতো "গালিব" নামে এক কুঠার ও তার মা। কুঠারের বাবা যখন বেচে ছিলেন তখন তারা মোটামুটি ভালোই ছিলেন। তার বাবা ছিলেন এই রাজ্যের অনেক বড় ব্যবসায়ী কিন্তু তার বাবা মারা যাওয়ার পর তাদের সব সম্পত্তি তাদের বিশ্বাসী লোকেরা বিশ্বাসঘাতকতা করে নিয়ে যায়।  সেই থেকে তারা রাজধানী ছেড়ে  বনের পাশে রাজ্যের শেষ সীমানায় এসে আশ্রয় নেন।

একদিন গালিব বাজারে কাঠ বিক্রি করতে গিয়ে রাজার ঘোষণা শুনে আসেন। সেও মনে মনে রাজকন্যাকে ভালোবাসতেন, যখন গালিব ছোট ছিলো তখন সে প্রায় ই তার বাবার সাথে রাজদরবারে যেতেন। সেখানেই সে রাজকন্যাকে দেখেন।আজ তার নিজের উপর খুব কষ্ট লাগলো। তাদের যদি আগের অবস্থা থাকতো তবে সে তার সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে হলেও রাজার দেয়া শর্ত পূরণের চেষ্টা করতেন যদিও এইটা কখনোই সম্ভব ছিলো না। গালিব বাজার থেকে ফিরে এসে মুখ গোমড়া করে বসে রইলেন। 

তার মা তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,"বাবা,কি হইছে তোর? বাজার থেকে আসার পর থেকেই দেখছি তোর মনটা খারাপ। কি হইছে বাবা?"

গালিব বললো,"মা, আমরা গরীব, এইটাই কি আমাদের দোষ।"

মা বললেন,"নাহ,বাবা,আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী কারণ আমরা কারো অপকার করি না, কারো ক্ষতি করি না। "

গালিব বললো,"মা,আমি রাজকন্যাকে ভালোবাসি।আমি ওকে বিয়ে করতে চাই কিন্তু আমরা যে গরীব আর রাজা ঘোষণা দিছেন, যে তার প্রাসাদের সামনে নদীর উপর একটা স্বর্ণের ব্রীজ বানিয়ে দিতে পারবে তার সাথেই রাজা মেয়েকে বিয়ে দিবেন।"

গালিবের মা খুব বুদ্ধিমতী ছিলেন সে সব শুনে বললো,"বাবা,নদীর উপর স্বর্ণের ব্রীজ বানাতে কেউ ই পারবে না। রাজা নিশ্চয়ই অন্য কোনো উদ্দ্যেশ্যে এই কথা বলেছেন।তুমি আল্লাহর উপর ভরশা রাখো। ইনশাল্লাহ, সব ঠিক হয়ে যাবে।"

গালিবের মায়ের কথা শুনে গালিবের মনে একটু শান্তি লাগলো। সে খুশিতে মা কে জড়িয়ে ধরে বললো,"ইনশাআল্লাহ, মা, তুমি আমাকে দোয়া করো।একদিন আমিও বাবার মতো বড় ব্যবসায়ী হবো। আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাদের পরীক্ষা করছেন।আল্লাহ একদিন আমাদের সবকিছু ফিরিয়ে দিবেন।"



পরদিন সকালে গালিব খুব ভোরে কাঠ কাটতে বের হয়ে গেলো। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত কাঠ কেটে যেই না সে বাসায় ফিরছে অমনি সে পথের ধারে এক অচেনা কন্ঠ শুনতে পারলেন। কেউ চিৎকার করে তার কাছে সাহায্য চাইছে কিন্তু সে কোথাও কাউকে দেখলো না। এইভাবে কিছুক্ষন যাওয়ার পর সে দেখলো একটা বড় সাপ পাশের ঝোপ থেকে বের হয়ে তার দিকে আসছে।

 গালিব কে অবাক করে দিয়ে সাপটা মানুষের কণ্ঠের মতো করে বললো,"ভাই,আমাকে বাচান। এক সাপুড়ে আমার পিছনে আসছে আমাকে ধরার জন্য। আমি কোনো সাধারণ সাপ না, আপনি আমাকে আপনার পিঠের পিছনে লুকিয়ে রাখুন। আমি একদিন আপনার এই ঋন শোধ করবো।"

গালিবের তখনো যেনো কিছু বিশ্বাস হচ্ছে না। কি ঘটছে তার সাথে এইসব! সে স্বপ্ন দেখছে না তো! 

গালিব বললো,"তুমি একটা সাপ,আমি যদি তোমাকে পিঠে লুকিয়ে রাখি আর তারপর তুমি যদি আমাকে কামড় দাও তখন কি হবে! আমি তোমাকে কিভাবে বিশ্বাস করতে পারি।"

সাপটি বললো,"ভাই,তুমি আমাকে একবারের জন্য বিশ্বাস করো, আমাকে বাচাও।" এই বলে সাপটা গালিবের কাছে মিনতি করতে লাগলো।

গালিবের কিছুক্ষনের জন্য কি জানি কি হয়ে গেলো। সে সিদ্ধান্ত নিলো যে যা হয় হবে তবুও সে সাপটাকে সাহায্য করবে। সে তৎক্ষনাৎ সাপটিকে পিঠে লুকিয়ে রাখলো। 

কিছুক্ষন পর সাপুড়ে দৌড় আসলো। সে গালিবকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,"এই যে যুবক,তুমি কি এই পথে কোনো সাপ যেতে দেখেছো?"

গালিব বললো,"হ্যা জনাব, আমি রাস্তার পাশে একটি সাপ দেখেছি। সাপটি বনের দিকে চলে গেলো"।

সাপুড়ে কে খুব হতাশ দেখালো যেনো সে খুব মহা মূল্যবান কিছু হারিয়ে ফেলেছে। সে গালিবের সাথে আর কথা না বাড়িয়ে বনের দিকে ছুটতে লাগলো।

গালিব সাপটিকে বললো,"এইবার তুমি বের হও, সাপুড়ে চলে গেছে।"

সাপটি বললো,"এখানে না, তুমি আমাকে তোমার বাসায় নিয়ে চলো।সাপুড়ে আবার যেকোনো মূহুর্তে আসতে পারে।"

গালিব তো পরে গেলো আরেক ঝামেলায়। বাসায় গিয়ে সে মাকে কি বলবে! অনেক চিন্তা ভাবনা করে সে ভাবলো সাপটিকে সে বাসায় ই নিয়ে যাবে। 


বাসায় এসে গালিব মাথা থেকে কাঠগুলো নামিয়ে সাপটাকে পিঠের পিছন থেকে বের করলো। গালিবের মা এত বড় সাপটিকে দেখে ভয় পেয়ে গেলেন।

সে গালিবকে বললো,"গালিব,তুই এই সাপ এনেছিস কেনো?"

সে ভয় পেয়ে দূরে সরে যেতেই সাপটি বললো,"মা, আমাকে ভয় পাবেন না। আমি আপনার কোনো ক্ষতি করবো না। আপনার ছেলে আজ আমার জীবন বাচিয়েছে।"

গালিব বনের সব ঘটনা তার মাকে খুলে বললো।

তার মা তো অবাক। 

সাপটি গালিবকে বললো,"গালিব ভাই, আজ তুমি আমার জান বাচিয়েছো। আজ থেকে আমরা ভাই-ভাই।তুমি আমার সাথে তোমার এই ভাইয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাবে?"

গালিব কিছু বললো না। এই কিছুক্ষন আগেই সাপটির সাথে তার পরিচয় আর সাপটিও কেমন অদ্ভুত, একদম মানুষের মতো কথা বলে!

গালিবের মা সাপটিকে বললো,"তোমার বাড়ি কোথায়? আমার ছেলে কখনো এই রাজ্যের বাইরে যায় নি আর একটা সাপের বাসায় সে ই বা কিভাবে যাবে বেড়াতে! "

সাপটি বললো,"সাত সাগর আর তের নদীর ওপারে আমাদের রাজ্য। আমার বাবা সেই রাজ্যের রাজা।আমার বাবা যখন জানবে তুমি আমার জীবন বাচিয়েছো তখন সে তোমাকে দেখলে খুশি হবে।"

গালিব বললো,"আচ্ছা, ভাই বলে যেহেতু ডেকেছো সেহেতু তোমাকে ভাই হিসেবে বিশ্বাস করছি যদিও এর আগে আমরা বিশ্বাস করে ঠকেছি।"

সাপটি বললো,"আমি মানুষ নই, আমি সাপ। সাপেরা কারো সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে না যদিনা কেউ তাদের ক্ষতি করে আর তুমি তো আমাকে বাচিয়েছো।"

গালিবের মা বললো," গালিব, এই দুনিয়ায় তো আর আমাদের কেউ নেই। এই সাপ তোকে ভাই বলে ডেকেছে। ভাইয়ের ডাক ফিরিয়ে দিতে নেই। তুই যা ওদের রাজ্যে। আমার দোয়া থাকবে তোর সাথে।"

সাপটি শুনে খুব খুশি হলো।

সে বললো,"আচ্ছা, ঠিক আছে। আমরা কালকে সকালে রওনা দিবো। "


 দ্বিতীয় পর্বের জন্য ক্লিক করুন


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন