দ্বিতীয় অংশ
🍁
![]() |
কুঞ্জ কাননে স্বাগতম! কুঞ্জ কানন মনে রাখুন |
মুরাদ সাহেব, শাহে্র বাবা,এই অত্র অঞ্চলের নামকরা ডাক্তার। চাকুরী সুবাদে এই মফস্বল শহরে শাহ্ এর মাকে নিয়ে এসেছিলো ৩০ বছর আগে। এই গ্রামের লোকের ভালোবাসা তাকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছিলো, এখান থেকে আর যাওয়া হয় নি!
স্বেচ্ছা অবসরের পর এই গ্রামে নিজের সঞ্চয় দিয়ে গড়েছেন সুবিশাল হাসপাতাল, শখ করে নাম দিয়েছেন "কানন কুঞ্জ"। তার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানটি দেখতে দেখতে একযুগ পার হয়ে গেলো। ১২ বছর পূর্তি উপলক্ষে হাসপাতালে আজ উৎসবের আমেজ। কত শত শত রোগীর সুস্থ থাকার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়েছে এখানে । হাসপাতালের এক একটা ইট যেনো মানুষের দোয়ায় বেচে থাকে!
হাসপাতালের অডিটোরিয়াম সুসজ্জিত সাজে আজ সাজানো হয়েছে। মুরাদ সাহেবের অনুরোধেই কেউ কোনো সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবস্থা করে নি!! যদি কোনোভাবে রোগীদের অসুবিধা হয়। মফস্বলের নামকরা হাফেজের কোরআন তিলওয়াত দিয়ে শুরু হলো আজকের অনুষ্ঠান। তারপর মঞ্চে স্বাগত বক্তব্য দিত উঠলেন এই অঞ্চলের উপজেলা চেয়ারম্যান আকবর সোবাহান , তিনি আবেগ মাখা ও কন্ঠে বললেন," আজ আমাদের আনন্দের দিন, ১২ বছর আগে আজকের দিনেই মুরাদ এই হসপিটাল তৈরি করেছিলেন। আমি একজন প্রশাসক হিসেবে নিজের ব্যর্থতা জ্ঞাপন করছি, এই অঞ্চলের সরকারী জেনারেল হসপিটালে যেই সেবা দিতে পারে নি, তা আমরা এই হসপিটাল থেকে পেয়েছি। আমি একজন প্রশাসক হিসেবে ব্যর্থ কিন্তু আমি একজন ভাই ও বন্ধু হিসেবে গর্বিত "।
সাথে সাথে অডিটোরিয়াম মফস্বলবাসীর হাততালীতে ভরে উঠলে। সত্যিই মুরাদ সাহেব ও আকবর সোবাহানের বন্ধুত্ব দেখার মতোন আর হবেইবা না কেন, সবাই যখন মুরাদ সাহেবকে চেয়ারম্যান পদে দাড়ানোর কথা বলছিলেন তখন মুরাদ সাহেব নিজে অপরাগতা জানিয়ে এই আকবর সোবাহানকে প্রার্থী করে সমর্থন দিয়েছিলেন। সেই থেকে আজ অব্দি আকবর সোবাহান এই অঞ্চলের উপজেলা চেয়ারম্যান। আকবর সাহেব নিজেও এই সমর্থনের মান রেখেছেন।
মঞ্চে উপবিষ্ট মুরাদ সাহেব একটু লজ্জাই পাচ্ছিলেন, যেনো ৬ ফুট ২ ইঞ্চির বিশাল দেহী লোকটা গুটিসুটি মেরে বসে আছে ! আজ গর্বের দিন তার কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও বাবার মনের শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয় , কোথাও যেনো একটা কমতি রয়েই গেলো। একজন বাবা যে সবসময় তার ছেলের চোখে হিরো হতে চায়।
দর্শক সাড়িতে বসা তার স্ত্রী কুঞ্জ বেগম আর তার মেয়ে শাহরিন, ওদের চোখে চোখ পড়তেই যেনো ভরশা পেলেন। তার জীবনের এত চড়াই-উতরাই এ কুঞ্জ বেগম তাকে শক্তি দিয়েন গেছেন।
নাম ঘোষণা হতেই মঞ্চে মুরাদ সাহেব উঠে দাড়ালেন, সবাইকে সালাম দিয়ে বললেন, আজকের এই দিনটা আমার না, আজকের এই আনন্দের দিন আপনাদের! শুধু অনুরোধ থাকবে, আপনাদের আনন্দের মঞ্চে ছোট্ট এক কোণায় জায়গা দিবেন, আমি খুশি থাকবো! আসুন আমরা এখানে সবাই প্রতিজ্ঞা করি, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমরা একে অপরের পাশে থাকবো, একসাথে বেচে থাকবো"।
"বাহ বাহ,কি সুন্দর করে বললেন ডাক্তার সাহেব " দ্বিতীয় সাড়িতে থাকা এক মহিলা বলে উঠল।
এইদিকে সামনে বসা কুঞ্জ বেগম ঠিক ই শুনলেন তার স্বামীর প্রশংসা, গর্বে তার বুক ভরে উঠলো।
" হ্যা, ওনার মতো মানুষ হয় না এত নরম মনের মানুষ আর দ্বিতীয়টা হয় না, আমার মনে হয় হাটতে গিয়ে কোনো পিপড়াকে পিষে দিলেও সে সারা রাত দূ:খে ঘুমাতে পারবে না " কথাটা একজন বলে শেষ করার আগেই পাশ থেকে আরেকজন বলে উঠলো, "ওনি পুরো গ্রামকে সময় দিতে গিয়ে, নিজের সন্তানকেই মানুষ করতে পারেন নি। কে বলবে, এই বাবার সন্তান শাহ্!! "
কথাটা শুনে কুঞ্জ বেগমের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। শাহরিনও মায়ের হাতটা চেপে ধরলো। ও বুঝতে পারছে মায়ের অনূভুতি। প্রতিটা অনাগত মায়ের মনেও একজন মা লুকিয়ে থাকে, সে ঠিক ই বোঝে মায়ের আবেগ, ব্যাথা।
"শাহরিন, আজকে শাহ্ এখানে এসেছে! আমার কেন জানি মনে হচ্ছে শাহ্ এখানে এসেছে। আজকের দিনে ও না এসে পারে না! " কুঞ্জ বেগম কথাটা বলেই চোখের অশ্রু লুকিয়ে ফেললো। মায়েদের লুকিয়ে কান্না শিখতে হয়! সন্তান ও পরিবারের জন্য সব মায়া উজার করে দিয়ে নিজে বাধা পড়ে যায় তাদের জীবনে! দেখা গেলো, কাদলেও ওদের জন্য আর হাসতেও ওদেরই লাগে! এই বুঝি পরিবার।
শাহ্ যদি আজকে অদৃশ্য হতে পারতো তবে নিশ্চয়ই সে তার বাবাকে একবার জড়িয়ে ধরে আসতো, লোকটা তাকে ভালোবাসে। অন্ধের মতো ভালোবাসে কিন্তু সেই অন্ধের চোখের সামনে যখন ন্যায়ের পর্দা বেধে দেওয়া হয় তখন নিজের কষ্টের চেয়েও ন্যায়টাকেই বেছে নেয়, ভাবতে ভাবতেই গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়লো শাহ্ । বেশিক্ষন এখানে বসে থাকতে পারবে না সে। শুধু মাত্র তার বাবার মুখের কথা রাখতেই শাহ্কে আগামী একবছরের জন্য এই "হরিণাপুর" ছেড়ে অজ্ঞাতবাস থাকতে হবে। সেইদিন ভরা বাজারে বাবা যদি এই শাস্তির কথা ঘোষণা দিয়ে কথা না দিতেন তবে কারো ক্ষমতা ছিলো না শাহে্র বিচার করা!
" না, আর দাঁড়ানো যাবে না এখানে " বিড়বিড় করতে করতে বলে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নদীর ঘাটের দিকে চলে গেলো।আজকে রাব্বিকে আসার ব্যাপারটি জানায় নি শাহ্, আজকে তার চলে যাওয়ার আগে আরেকটা কাজ আছে, ঐশ্বর্য কে দূর থেকে একটু চোখের দেখা দেখে আসা। পুরো হরিণাপুর আজ এখানে, এখন ই ঐশ্বর্যকে দেখে আসা যাবে আর রাব্বি জানলে কখনোই শাহ্কে যেতে দিতো না। আর শাহ্ নিজেও চায়, শুধু রাব্বি না, যাকে সে দেখতে যাবে, সেই ঐশ্বর্য , সেও যেনো না জানে যে, শাহ্ তাকে দেখতে গেছে। শাহ্ নিজের কাছেও নিজে ছোট হবে, হয়তো ভালোবাসায় এতটুকু লুকোচুরী করাই যায়, যেইটা শুধু এই দো জাহানের বাদশাহ আর শাহ্ নিজেই জানবে কিন্ত যাকে ভালবাসে তার কাছে যেনো তার আর ছোট হওয়া না লাগে!!!!
চলবে...তৃতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন....